ভারত গত বুধবার পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিভুক্ত কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্রতর হয়েছে। “অপারেশন সিঁদুর”-এর অংশ হিসেবে চালানো এই হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে একটি তিন বছরের শিশুও রয়েছে। ভারত দাবি করেছে, এই হামলার লক্ষ্য ছিল নয়টি স্থানে “সন্ত্রাসবাদী অবকাঠামো” ধ্বংস করা।
টার্গেট করা স্থানগুলোর মধ্যে পাকিস্তান-অধিভুক্ত কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ, কোটলি ও ভিম্বার এবং পাঞ্জাব প্রদেশের চারটি এলাকাও ছিল—১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এই প্রথমবার ভারত পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে হামলা চালাল।
ভারত জানায়, এপ্রিল ২২ তারিখে পর্যটন শহর পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৫ জন পর্যটক ও এক স্থানীয় গাইড নিহত হওয়ার প্রতিশোধস্বরূপ তারা এই আক্রমণ চালিয়েছে। হামলাকারীরা নন-মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তু করেছিল বলে অভিযোগ।
পাকিস্তান পাল্টা দাবি করেছে, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এ বিষয়ে ভারত এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। এদিকে, ভারত-অধিভুক্ত কাশ্মীরে পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক হামলায় অন্তত ১০ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
দীর্ঘদিনের বৈরিতা
দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে এই সহিংসতা তাদের দীর্ঘদিনের বৈরিতারই ধারাবাহিকতা। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ এখনো অব্যাহত। উভয় দেশই কাশ্মীরের সম্পূর্ণ অঞ্চল নিজেদের দাবি করলেও বাস্তবে তারা এর কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
২০১৯ সালে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জনের বেশি ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হলে ভারত বালাকোটে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালায়। তবে ওই হামলার কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
সামরিক সক্ষমতা
গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের ২০২৫ সালের র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সামরিক শক্তি, আর পাকিস্তান রয়েছে ১২তম অবস্থানে। ২০২৪ সালে ভারতের সামরিক ব্যয় ছিল ৮৬ বিলিয়ন ডলার (জিডিপির ২.৩%), আর পাকিস্তানের ব্যয় ছিল ১০.২ বিলিয়ন ডলার (জিডিপির ২.৭%)।
জনবল ও সামরিক সরঞ্জাম:
ভারত: ৫.১ মিলিয়ন সামরিক কর্মী, ২,২২৯টি বিমান, ৩,১৫১টি ট্যাংক, ২৯৩টি নৌসামরিক বাহিনী।
পাকিস্তান: ১.৭ মিলিয়ন সামরিক কর্মী, ১,৩৯৯টি বিমান, ১,৮৩৯টি ট্যাংক, ১২১টি নৌসামরিক বাহিনী।
ভারতের নৌবাহিনী ৬,১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা রক্ষা করে, আর পাকিস্তান তার ১,০৪৬ কিলোমিটার উপকূল রক্ষা করে।
পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার
উভয় দেশই ১৯৯৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের পারমাণবিক শক্তি ঘোষণা করে, যদিও ভারত প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় ১৯৭৪ সালে। ভারতের পারমাণবিক নীতি দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং মোবাইল স্থলভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। রাশিয়ার সঙ্গে সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র নিয়েও ভারত কাজ করছে।
পাকিস্তানের পারমাণবিক কৌশল স্বল্প ও মধ্য-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল, যা ভারতীয় শহরগুলোতে আঘাত হানতে সক্ষম। চীন পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আইক্যান (ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স)-এর তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ভারত পারমাণবিক অস্ত্রের পেছনে ২.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, আর পাকিস্তান ব্যয় করেছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
অস্ত্র আমদানি
ইউক্রেনের পর ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক, ২০২০–২০২৪ সময়কালে বিশ্বের ৮.৩% অস্ত্র আমদানি করেছে। রাশিয়া ভারতের প্রধান সরবরাহকারী হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফ্রান্স, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকেও ভারত অস্ত্র আমদানি বাড়িয়েছে।
পাকিস্তান অস্ত্র আমদানির দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে এবং তাদের আমদানি ৬১% বেড়েছে। ২০২০–২০২৪ সময়ে চীন পাকিস্তানের ৮১% অস্ত্রের যোগানদাতা ছিল।
সহিংসতা আবারো বেড়ে যাওয়ায় দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সম্ভাব্য বৃহৎ সংঘাতের আশঙ্কা বিশ্বজুড়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
সূত্র: আল-জাজিরা