14.8 C
New York
12.7 C
Zurich
31 C
Dhaka
Thursday, May 1, 2025
HomeDhakaলেজার অস্ত্রে ঝুঁকছে ইরান

লেজার অস্ত্রে ঝুঁকছে ইরান

বিশ্বের সামরিক শক্তির ভারসাম্য আজ শুধু পরমাণু বোমা কিংবা আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল নয়। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি বিশেষ করে ‘ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন’ বা ডিইডব্লিউয়ের বিকাশ যুদ্ধক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এই প্রযুক্তির অন্যতম আবিষ্কার হলো লেজার অস্ত্র, যা শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী আলোর মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে। এক সময় এ অস্ত্র কল্পবিজ্ঞান সিনেমায় সীমাবদ্ধ থাকলেও, আজ বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতাকে গ্রহণ করে সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছে ইরান। ইরানের লেজার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির গবেষণা, ব্যবহার, সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে সাজানো এ প্রতিবেদন।

লেজার অস্ত্র কীভাবে কাজ করে

লেজার অস্ত্রকে সাধারণত বলা হয় ডিইডব্লিউ বা ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন। এটি মূলত একটি উচ্চমাত্রার ফোকাসড ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন, যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে শক্তি পাঠিয়ে তা গলিয়ে ফেলতে সক্ষম। এতে গোলা-বারুদের প্রয়োজন হয় না। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আলো নির্গত করে এ ধরনের অস্ত্র একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে প্রচণ্ড তাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে ধাতব বস্তু, ড্রোন, সেন্সর, রাডার সহজেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এই অস্ত্র ব্যবহারে অত্যাধুনিক সেন্সর, এআই গাইডেড ট্র্যাকিং, সলিড স্টেট ফাইবার লেজার প্রযুক্তি, বিম কম্বাইনিং সিস্টেম ও অটোমেটেড ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেমের প্রয়োজন পড়ে। লেজার অস্ত্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—অত্যন্ত দ্রুত গতিতে আঘাত করা যায়, গোলাবারুদের খরচ লাগে না এবং পুরোপুরি নীরব (সাইলেন্ট) অপারেশন।

ইরানের লেজার অস্ত্রের ইতিহাস

ইরানের লেজার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু হয় ১৯৭০ এর দশকে। দেশটির পারমাণবিক শক্তি সংস্থার তত্ত্বাবধানে লেজার গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে এই কর্মসূচির সূচনা হয়। এরপর থেকে গ্যাস লেজার, সেমিকন্ডাক্টর লেজার ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেজার তৈরিতে ধারাবাহিক উন্নতি ঘটাতে থাকে দেশটি। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ এবং ২০২০ সালে ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন লেজারের সফল পরীক্ষার মাধ্যমে ইরান বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি লেজার প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশের কাতারে চলে আসে। এরপর ২০২২ সালে তারা পরীক্ষামূলকভাবে ‘বিনা’ নামের লেজার-নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে। ইরান কেবল প্রতিরক্ষা নয়, লেজার প্রযুক্তিকে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করেও সামরিক সিস্টেম শক্তিশালী করছে।

‘সাইলেন্ট হান্টার’ ও ‘সুরুজ ’

ইরানের অন্যতম লেজার প্রতিরক্ষা সিস্টেম হলো ‘সাইলেন্ট হান্টার’। চীনের পলি টেকনোলজিস কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি এই সিস্টেমের ক্ষমতা ২০-৩০ কিলোওয়াট এবং এটি ২-৪ কিলোমিটার রেঞ্জে কার্যকর। ছোট ড্রোন, এফপিভি ড্রোন ও সার্ভিলেন্স ইউএভির বিরুদ্ধে এটি খুবই কার্যকর। এটি এইএসএ রাডার ও অপটিক্যাল ট্র্যাকিং সেন্সরের মাধ্যমে টার্গেট শনাক্ত করে এবং নিঃশব্দে ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে, ‘সুরুজ’ হচ্ছে ইরানের নিজস্বভাবে তৈরি বিমান প্রতিরক্ষা লেজার সিস্টেম। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এটি প্রথমবারের মতো বৃহৎ সামরিক মহড়ায় ব্যবহার করা হয়। এটি মূলত আকাশপথে আক্রমণকারী শত্রু ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং সংবেদনশীল অবকাঠামোর সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

প্রযুক্তির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা

লেজার অস্ত্রের অন্যতম বড় সুবিধা হলো- আলো গতির অস্ত্র হওয়ায় শত্রু প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই ধ্বংস হয়। গোলাবারুদ, মিসাইল ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। এতে খরচ কম। এই অস্ত্রের অপারেশনে কোনো শব্দ নেই। একাধিকবার ফায়ার করা যায়, পুনরায় লোডের প্রয়োজন পড়ে না। তবে এই প্রযুক্তির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে: বৃষ্টি, কুয়াশা, ধোঁয়ার কারণে লেজার কার্যকারিতা কমে যায়। খুব দূরের টার্গেট আঘাত করা সম্ভব হয় না। এটি পরিচালনায় অত্যন্ত শক্তিশালী পাওয়ার সাপ্লাই লাগে।

কৌশলগত গুরুত্ব

ইরানের এই অগ্রগতি কেবল প্রযুক্তিগত নয়, কৌশলগত দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও উপসাগরীয় অঞ্চলের শত্রুপক্ষগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লেজার প্রযুক্তি ইরানের জন্য এক বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ড্রোন ওয়ারফেয়ারে বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল অল্প খরচে ছোট ড্রোন ব্যবহার করে টার্গেট করে থাকে, তখন ইরানের লেজার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেই আক্রমণ রুখে দিতে সক্ষম। এতে যুদ্ধ ব্যয় কমে, পাল্টা আঘাত সম্ভব হয় এবং সর্বোপরি আত্মরক্ষার একটি কার্যকর ও সাশ্রয়ী উপায় পাওয়া যায়।

ইরানের নিজস্ব অবস্থান

অনেক দেশের ওপর দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও ইরানের লেজার প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া বা রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে প্রযুক্তিগত সহায়তা বিনিময়ের মাধ্যমে ইরান নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। ইরান এখন শুধু একটি আঞ্চলিক শক্তি নয়, বরং প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষা খাতে এক উদীয়মান আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এর উদাহরণ হলো তাদের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী, গবেষণা কার্যক্রম ও বাস্তব যুদ্ধে প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ হচ্ছে।

ইরানের প্রস্তুতি

লেজার প্রযুক্তি শুধু সামরিক ব্যবস্থার জন্য নয়, চিকিৎসা, শিল্প, জ্বালানি ও পরিবেশ সুরক্ষার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ইরান এ বিষয়গুলোতেও গবেষণা জোরদার করেছে। ভবিষ্যতে ইরান চাইছে—লেজার প্রযুক্তিকে সিভিল ও ডুয়াল-ইউজ অ্যাপ্লিকেশনে ব্যবহার করে বৈশ্বিকভাবে নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের লেজার অস্ত্র ব্যবস্থার উন্নয়ন যুদ্ধক্ষেত্রে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে। এটি শুধু ইরানকেই নয়, গোটা বিশ্বের প্রতিরক্ষা সমীকরণে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সামরিক প্রযুক্তির এই অস্ত্র সামনে যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ রূপরেখা পাল্টে দিচ্ছে।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

9,600FansLike

Latest Articles