15.3 C
New York
5.2 C
Zurich
24 C
Dhaka
Friday, April 18, 2025
HomeDhakaখাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সময় হবে কবে?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সময় হবে কবে?

বাংলা একসময় বিশ্বের সবথেকে সম্পদশালী অঞ্চল ছিল। ভূল নীতির কারনে এই ভূখন্ডে ভয়ানক কিছু দূর্ভিক্ষ হয়েছিল। এর মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ যে দূর্ভিক্ষ হয় সেটা হল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হয়েছিল বাংলা ১১৭৬ সালে। ইংরেজি সন হিসাবে ১৭৭০ সালে। ধারনা করা হয় শুধু খাদ্যের অভাবে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। সংখ্যাটা প্রায় ১ কোটি।

এর পর আরেকটি ভয়ানক ভয়ানক দূর্ভিক্ষ হয়েছিল যেটাকে তেতাল্লিশের মন্বন্তর বা পঞ্চাশের মন্বন্তর বলে। বাংলা ১৩৫০ এবং ইংরেজি ১৯৪৩ সালে দেখা দেয় এই দূর্ভিক্ষ। জাপান প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার (তৎকালীন বার্মা) দখল করে নেওয়ার পর তেতাল্লিশের মন্বন্তর শুরু হয়। ওই সময় বার্মা ছিল চাল আমদানির বড় উৎস। এই মন্বন্তরে বাংলাজুড়ে প্রায় ৩০ লক্ষ লোক না খেয়ে মারা যান।

বার্মা ফ্রন্টে যখন ভয়ানক যুদ্ধ চলছে তখন বার্মা থেকে চাল আসা বন্ধ হয়ে যায়। ব্রিটিশরা সাধারন মানুষদের দুর্দশা আমলে না নিয়ে শুধুমাত্র সৈন্যদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খাদ্য মজুদ করে। ফলে এই ভূখন্ডে মারা যায় ৩০ লক্ষ মানুষ।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সবথেকে ভয়াবহ যে দূর্ভিক্ষ হয় সেটি ১৯৭৪ সালে। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২৭০০০ বলা হলেও বিভিন্ন সূত্রে আনুমানিক প্রায় ৪,৫০,০০০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

এই দূর্ভিক্ষের কারন হিসাবে বলা হয়ে থাকে যে ত্রানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া কৃষক তাদের নিজেদের জন্য খুব বেশি খাদ্য মজুদ করেনি। সেই সাথে বন্যা। তবে সবথেকে বড় খাদ্য ঝুকির উপর পড়ে বাংলাদেশ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিশ্রুত ২২ লক্ষ টন খাদ্য সহায়তা বন্ধ ঘোষনা করে। এর পেছনে আমেরিকার যুক্তি ছিল কিউবায় পাট রপ্তানি করা যাবে না। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কিউবায় খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। তবে মার্কিন খাদ্য সহায়তা আসতে আসতে প্রায় নভেম্বর মাস চলে আসে। এর ভেতর ক্ষতি যা হবার তা হয়ে যায়।

১৯৭৪ সালে সারাবিশ্বে খাদ্যের দাম বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ভারত খাদ্য সহায়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তবে সবথেকে বড় যে সমস্যা আমাদের হয়েছিল সেটি হল বন্যা, দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধি, খাদ্যশস্য মজুতের সরকারী অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক দূর্নীতি, জেলাগুলির মধ্যে খাদ্যশস্য আনা-নেয়ার সীমাবদ্ধ আইন, প্রতিবেশী দেশগুলিতে খাদ্যশস্য চোরাচালান এবং তথাকথিত বিতরণ ব্যর্থতা।

দূর্নীতি ও বিতরন ব্যাবস্থার দূর্বলতা বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণকে ব্যর্থ করে দেয়। মজুদদারি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এমন পরিস্থিতি থেকে আমাদের এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।

সঠিক পরিকল্পনা কার্য সম্পাদনের অর্ধেক। সমাজতন্ত্র নিয়ে ধারনা কম। তবুও এটা বুঝতে রকেট সাইন্টিস্ট হওয়া দরকার নেই যে যেসব পণ্যের দামের সাথে প্রান্তিক জনগন জড়িত সেসব পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানো ভয়ঙ্কর পরিনতি ডেকে আনতে পারে। পত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম দেশের খাদ্যপণ্যের বাজার ৪-৫ টা বড় শিল্পগ্রুপের হাতে। মোট আমদানির প্রায় পুরটায় তারা করে। ফলে বাজারে মূল্য নির্ধারনে এসব গ্রুপের নিয়ন্ত্রন রয়েছে বা প্রভাবিত করবার ঝুকি আছে।

যে বিষয়টি এর আগেও বার বার বলে আসছি সেটি হল, সমাজের গরিব শ্রেনীর মানুষের আয়ের বিপরীতে ব্যায়ের খাতগুলি বিবেচনায় নিতে হবে। যে যত বেশি গরিব তার আয়ের তত বেশি ব্যয় হবে বেসিক নিড যেমন খাদ্য পণ্যের পেছনে। আর একারনেই এই বাজারে মূল্যের উত্থান পতনে সবথেকে বেশি প্রভাবিত হয় এই শ্রেনী।

এক্ষেত্রে আমাদের সবার অভিজ্ঞতা যেটা বলে সেটি হল মূল্য বৃদ্ধির জন্য যেসকল কারন গুলিকে দায়ী করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হল- সরবরাহ ঘাটতি, বৈশ্বিক মূল্য বৃদ্বি। এই সমস্যা কি কাটিয়ে উঠা সম্ভব না? অবশ্যই সম্ভব।

দুই বছর আগের কথা সবার মনে আছে। ভারত কোন রকম অগ্রিম বার্তা না দিয়ে হুট করে পেয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সাথে সাথেই এক শ্রেনী এই জরুরি পণ্যের মজুদ শুরু করে। বাজারে দাম ২০০ টাকা কেজি ছাড়িয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসার পর দেখেছি গুদাম থেকে হাজার হাজার বস্তা পঁচা পেয়াজ ফেলে দিতে হয়েছে।

এগুলা আমরা কেন হতে দিব? বিশেষ করে যেসব পণ্যের সাথে মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত।

এর সমাধানটা যেভাবে হতে পারে সেটি হল মোট চাহিদার অন্তত ৩০% সরকারের নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে খাদ্য পণ্য, ভোজ্য তেল, জ্বালানি মজুদের জন্য ফুড সাইলো বা অন্যান্য স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি গড়ে তুলতে হবে। এরপর একটা এক্সপার্ট টিম প্রতিবছর সরকারি খাদ্যের মজুদের একটা প্রজেকশন করবেন। বৈশ্বিক বাজার বিবেচনায় নিয়ে যখন দাম কম অথবা বছরের যে সময়ে আমাদের কৃষকরা দাম কম পান তখন সরকার যথেষ্ট পরিমান পণ্যের স্টক ধরে রাখবেন।

এরপর অফ সিজনে যখন দাম বাড়তে থাকার ঝুকিতে থাকবে তখন সরবহার ঘাটতি সৃষ্টি হবার আশঙ্কা থাকলে অথবা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজারে নিয়মিত পণ্য সরবরাহ করবে। এতে একক কোন গোষ্ঠি মূল্য নির্ধারনে বড় প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে না।

সোজা বাংলায় বললে পেয়াজের কেজি যখন ১৫ টাকা তখন কৃষক ক্ষতির মূখে পড়ে। আবার বছরের কিছু সময় পেয়াজ ১০০ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে পেয়াজের অফ সিজনে কৃষকের কাঁছ থেকে সরকার ৩০ বা ৪০ টাকা কেজি দরে পণ্য কিনে বাজারে সর্বনিম্ন মূল্য ৩০ বা ৪০ টাকা রাখল। এরপর যখন বাড়তে থাকবে তখন মজুদ পণ্য বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ রেখে এই দাম এর উর্ধসীমা ৬০/৭০ টাকায় সীমাবন্ধ রাখল। এর ফলে কোন দেশ হুট করে কোন পণ্য রপ্তানি বন্ধ ঘোষনা করলেও আমরা বাজারের উপর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারব।

জ্বালানি তেল বা এলএনজির ক্ষেত্রেও মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। এতে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির হাত থেকে বেঁচে যাবে। সরবরাহকারী দেশের কাছ থেকে যে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে কম মূল্য থাকে তখন সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যখন মূল্য বৃদ্ধি পাবে তখন মূল্য সমন্বয় করে নেয়া যাবে। একটা দেশের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা খুব জরুরি। আর এক্ষেত্রে অন্তত ৮-১০ মাসের মজুদ রাখা উচিত। যত বেশি পারা যায় তত ভাল।

এগুলা কেন বলছি? বাংলাদেশে জমির পরিমান প্রতিবছর আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। কৃষি জমি কমছে। এর বিপরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনো হয়ত উচ্চ ফলনশীল জাতের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো গেলেও আগামীদিনগুলিতে ১৮ বা ২০ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা এই সল্প জমি দিয়ে পুষাবে না। ধীরে ধীরে আমরা আমদানি নির্ভর দেশে পরিনত হতে থাকব। যত বছর গড়াবে ততই আমাদের খাদ্য পণ্যে আমদানি নির্ভরতা বাড়তে থাকবে। আর এজন্যই বড় যে ঝুকি সৃষ্টি হবে সেটি হল আন্তর্জাতিক বাজারের শক আমাদের উপর আরো বেশি পড়তে থাকবে।

খাদ্য নিরাপত্তা বা জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সময় এখনি। আর এজন্যই আমাদের বিতরন ব্যাবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি মজুদকে বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রনে বাফার হিসাবে কাজ করতে হবে। জরুরি পণ্যে বাজার শৃঙখলা ফেরানোর বিকল্প নেই।

এত কিছু বলার কারন হল আগের পোস্টে অনেকেই ব্যাক্তিগত আক্রমন করেছেন। আপনাদের গঠনমূলক যে কোন সমালোচনার অধিকার আছে। আর কোথাও প্রশ্ন থাকলে সেটা করতে পারেন। সেটার উত্তর বা ব্যাখ্যা দিতেও আমি বাধ্য। কিন্তু যখন বাজে শব্দের প্রয়োগ হয় তখন সেটার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করিনা। উপরের বিষয়টি বিভিন্ন লেখায় বিভিন্ন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমার চিন্তাকে কেউ আমলে নিবে সেটার আশা না করেই লিখি। তবে আশা করতে দোষ নেই। হয়ত কোন এক সময় আমরা সবাই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলি নিয়ে ভাবতে শিখব সেই প্রত্যাশায়। সবথেকে বড় প্রত্যাশা হল সেন্সটিভ পণ্যগুলিতে সিন্ডিকেটের প্রভাব দূর হোক।

#wasimahin

ছবি: সংগৃহীত

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

9,600FansLike

Latest Articles