4.4 C
New York
13.4 C
Zurich
32 C
Dhaka
Sunday, April 13, 2025
HomeDhakaঅবসর যাওয়ার প্রাক্কালে সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে আমার শেষ ভাষণ

অবসর যাওয়ার প্রাক্কালে সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে আমার শেষ ভাষণ

২৬ জুন ২০১৫

আজ রাতে আমি আমার মনে জমে থাকা কিছু অনুভূতি প্রকাশ করতে যাচ্ছি, যেগুলো এতদিন নিজের মধ্যেই আবদ্ধ রেখেছিলাম। এখন মনের ভেতর থেকে সেগুলো সবার সামনে তুলে ধরার একটি তাগিদ অনুভব করছি। সুন্দর ও মিষ্টি শব্দের মোড়কে বক্তব্যটি না সাজিয়ে আমি সরাসরি স্পষ্ট ভাষায় কথা বলব। এজন্য আমি প্রচলিত ছক থেকে বেরিয়ে এসে খোলামেলা ভাষাতেই বলবো। আমার বক্তব্য বেশ লম্বা হতে পারে, কিন্তু শেষবারের মতো আপনাদের ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করছি।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম…

লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক (সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত) এবং বেগম শোমা হক, নৌবাহিনী প্রধান, ভাইস অ্যাডমিরাল এম ফরিদ হাবিব এবং বেগম হাফিজা হাবিব, বিমানবাহিনী প্রধান, এয়ার মার্শাল আবু এসরার এবং বেগম তাসনিম এসরার, জনাব কাজী হাবিবুল আউয়াল, সিনিয়র সেক্রেটারি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, আমার সহকর্মী, সম্মানিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়বৃন্দ, আসসালামু আলাইকুম।

আমার ও আমার স্ত্রীর সম্মানে এত বড় পরিসরে যে বিদায়ী নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছে, তার জন্য আমি জেনারেল বেলাল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল কর্মকর্তাকে আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এভাবে সম্মান জানানোর জন্য আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

দীর্ঘ চাকুরী জীবনের পর এবার বিদায় নেওয়ার পালা। চট্টগ্রামে ১৯৭৬ সালের ১৯ মার্চ যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা ঢাকায় ২০১৫ সালের ২৫ জুন শেষ হতে চলেছে। ১৯৭৬ সালের মার্চে, যখন আমি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে পা রাখি, তখনই আমি আমার বাসা ও প্রিয়জনদের ছেড়ে চলে আসি। সেই থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হয়ে উঠে আমার ঘরবাড়ি। ৩৯ বছর সাধারণ মানুষের জীবনে অনেক বড় অধ্যায়। আর যদি পেছন ফিরে দেখি, অগণিত ঘটনা, কার্যক্রম আর কাজের ভিড় সেই সময়টুকুকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে। আমাকে দিনরাত ব্যস্ত রেখেছে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট থেকে ফোর-স্টার জেনারেল — আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা ও শ্রম দিয়েছি। যখন যেখানে দায়িত্ব পেয়েছি, সেখানেই শতভাগ পালন করেছি। আল্লাহ তাআলা আমাকে পুরস্কৃত করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার মতো একটি অভিজ্ঞতা দিয়েছেন।

শ্রদ্ধেয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়,

৩৯ বছরের সেবা ও অভিজ্ঞতা আজকের এই অবস্থানে আমাকে নিয়ে এসেছে। এ সময়ে সেনাবাহিনীর বহু অস্থির ও বেদনাদায়ক ঘটনা দেখেছি যেখানে উত্থান-পতনের ঢেউয়ে সেনাবাহিনী কখনও উপরে উঠেছে, কখনও নিচে নেমেছে। ১৯৭৭ সালের সামরিক অভ্যুত্থান ছিল ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনার ধারাবাহিকতা। সে অভ্যুত্থানে আমার নিজ ইউনিট ২২ ইস্ট বেঙ্গল ভেঙে দেয়া হয়। ১৯৮১সালে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা ও সামরিক ক্ষমতা দখল একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে আমাকে এক জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি করে, আর সেটি ছিল রাষ্ট্রচালনায় সামরিক বাহিনীর আসল ভূমিকা ঠিক কী?  ১৯৯০ সালে সামরিক সরকারের পতন আমাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিয়েছিল যে রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ কখনো সেনাবাহিনীর জন্য শুভ ফল বয়ে আনে না; বরং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সেনাবাহিনীর বিকাশ দুটোকেই বাধাগ্রস্ত করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে অভ্যুত্থানের চেষ্টা দেখিয়েছিল, একটি বিভাজিত বাহিনী কীভাবে সংকটকালে ভেঙে পড়তে পারে, আর সে ভাঙন ঠেকাতে আমাদের মধ্যে সংহতি কতটা জরুরি। কিছুটা সাময়িক স্থিতিশীলতার পর ১/১১ ফের দেখাল, কেবল কয়েকজন উচ্চভিলাষী ব্যক্তি কীভাবে সেনাবাহিনীকে তাদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের হাতিয়ার বানাতে পারে। দুবছরের সামরিক প্রভাবাধীন শাসন সেনাবাহিনীর মৌলিক নৈতিক ভিত্তি নাড়িয়ে দেয় এবং সেনাবাহিনীকে পেশাগত ধারার বাইরে ঠেলে দেয়। সব মিলিয়ে ফলাফল ছিল নেতিবাচক। পরবর্তিতে পিলখানা হত্যাকাণ্ড এসব ভুলকর্মের পরিণতি হিসেবে দেখা দেয়। এসব ঘটনার প্রভাব কেবল আমার ওপর নয়, এখানকার সবাইকেই স্পর্শ করেছে।

আমার কর্মজীবনের বড় একটা অংশ জুড়ে এ ধরনের ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করার পর, যখন আমাকে এই সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন কি ধরনের নেতৃত্ব-দর্শন বা কমান্ড-দর্শন আমার মাথায় আসতে পারে বলে আপনারা মনে করেন? উত্তর খুব সোজা – সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে পেশাগত ধারা বজায় রাখা।

সেনাবাহিনীকে পেশাগত ধারায় রাখা তুলনামূলকভাবে সহজ, কারণ এর জন্য স্পষ্টভাবে নির্ধারিত কাঠামো ও বিধিবিধান রয়েছে। কিন্তু বাহিনীকে রাজনীতির বাইরে রাখতে গেলে রাজনীতিবিদদেরও আমাদের সহায়তা করতে হবে। কীভাবে? অনেকে নানা যুক্তি দিতে পারেন, তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যদি রাজনীতিবিদরা সেনাবাহিনীর কমান্ড শৃঙ্খলাকে (Chain of Command) সম্মান করেন এবং সেনা সদস্যদের কোনো ধরনের গিমিক, বাইপাস বা শর্ট সার্কিটের সুযোগ না দেন, তাহলে রাজনীতিবিদ এবং সেনাবাহিনী— উভয়েরই মঙ্গল হবে।

সেনাবাহিনী মূলত একটি “সহিংস শক্তি”, কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে এটি বলপ্রয়োগ করে। তাই এটিকে শান্তিকালীন সময়ে তার নির্ধারিত সীমার মধ্যেই আটকে রাখা বান্ছনীয়, যেন এর সহিংস প্রভাব কখনোই বেসামরিক জনগোষ্ঠীর উপর নেমে না আসে। একে রূপকথার জিনের মত মুখ বন্ধ করে বোতলে আটকে রাখতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিভিন্ন সময়ে সেই বোতলের মুখ খুলে দেয়া হয়েছে, আর সে সুবাদে ডিজিএফআই, এসএসএফ, বিজিবি বা র‍্যাব-এর অফিসার ও সৈনিকরা বেসামরিক জীবনের স্পর্শে এসেছে; সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বাদই দিলাম। এর ফলে বাহিনীর যুদ্বোপযুক্ততা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে— যেভাবে খোলা বাতাসে লোহায় মরচে ধরে বাদামী খসখসে আবরণ তৈরি হয়। আপনারা এখানে উপস্থিত সকলে উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। বাহিনীর কল্যাণে আপনাদের সবাইকে ভাবতে হবে কীভাবে আমরা সম্মিলিতভাবে এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে সেনাবাহিনীকে রক্ষা করব।

এ পর্যন্ত যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি, সেগুলো আমার নেতৃত্ব-দর্শন বা কমান্ড- দর্শন তৈরিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ২২ ইস্ট বেঙ্গল ভেঙে দেওয়া আমাকে খুব অল্প বয়সেই শিখিয়েছিল— সৈনিকদের কল্যাণের প্রতি অবহেলা করলে, বাহিনীর মধ্যে কী ভয়াবহ ফাটল ও অবিশ্বাসের ঝড় বইতে পারে, যা পারস্পরিক ঘৃণা ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যা দেখিয়েছিল— কেন সামরিক বাহিনীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনীতির বাইরে, ব্যারাকে সীমিত রাখা উচিত। বিভিন্ন সময়ে সামরিক আইন, সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক সরকারের পতন আমাকে বুঝিয়েছিল, কিভাবে এসব ঘটনায় আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- বিগত কয়েক দশকের জটিল বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক আমাকে শিখিয়েছিল— সামরিক বাহিনী সবসময়ই রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে থাকা উচিত।

এছাড়াও আরও কয়েকটি ঘটনা আমার কাছে এই পেশাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও ভিন্ন মনোভাব থেকে মূল্যায়ন করতে শিখিয়েছিল। একে একে সেগুলো বলি।

২২ ইস্ট বেঙ্গল বিদ্রোহ দমনের পর, ইউনিটের সব সৈনিককে তদন্ত ও বিচারের জন্য বন্দিশিবিরে রাখা হয়।  সৈনিকদের পরিবার যারা সেনানিবাস ও বগুড়া শহরের ভাড়া করা বাসায় থাকতো, তারা তখন প্রবল কষ্টে দিন পার করছিল। সেই সময়, আমরা ২২ ইস্ট বেঙ্গলের গুটিকয়েক কর্মকর্তা কাঁধে রেশনের বস্তা নিয়ে ঘুরে ঘুরে তাদের পরিবারের কাছে মাসিক রেশন পৌঁছে দিতাম। একদিন আমি জাহাঙ্গীরাবাদ ক্যান্টনমেন্টের কাছে ফুলতলা এলাকায় একটি বাড়িতে গেলাম। দরজা খুলছিল না, কিন্তু বারবার কড়া নাড়ার পর অবশেষে ছোট্ট একটি মেয়ে দরজা খুলল। ভেতরে গিয়ে দেখি, সৈনিকের স্ত্রী শয্যাশায়ী— মারাত্মক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। তার বড় মেয়ে, বয়স পনেরো-ষোলোর বেশি হবে না, মায়ের বিছানার পাশে বসে কোনোভাবে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। ঘরের মেঝে ভর্তি পাকস্থলীর বর্জ্য। পুরো ঘরটাতেই ছিল অবর্ণনীয় বিশৃঙ্খলা।

বিশ বছর বয়সী একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের পক্ষে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা ও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সত্যিই কঠিন ছিল। তখন মোবাইল ফোনও ছিল না। দ্রুতই আমি ইউনিট লাইনে ফিরে গেলাম, কিন্তু কেউই ছিল না— সবাই কাজ নিয়ে বাইরে। এরপর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে গিয়ে আধ ঘণ্টা অপেক্ষার পর ডিকিউ (DQ)-এর রুমে ঢোকার সুযোগ পেলাম। ঘটনা শুনে তিনি অদ্ভুতভাবে  নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বললেন, “তুমি স্টাফ ক্যাপ্টেনের রুমে অপেক্ষা কর।” আরও আধ ঘণ্টা অপেক্ষার পরও কিছু না হওয়ায় আমি আবার সেই বাড়িতে ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি, মা ইতোমধ্যে মারা গেছেন। তাঁর স্বামীকে (যিনি বন্দীশিবিরে ছিলেন) এ খবর জানানো হয়নি। বিচার শেষে তিনি ফাঁসির রায় পান এবং ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের দু সন্তানকে একজন সৈনিকের সঙ্গে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়— যিনি তাদের পরিচিত ছিলেন এবং গ্রাম কাছাকাছি  ছিল। মাত্র অল্প কয়েকজন মানুষের চরম অবহেলায় একটি সম্পূর্ণ পরিবার বিধ্বস্ত  হয়ে গেল— যা আজও আমাকে মানসিকভাবে তাড়া করে বেড়ায়। আমি জানি না সে দুই সন্তানের অবস্থা এখন কী, তবে আশা করি আল্লাহ তাদের ভালো রেখেছেন।

এই ঘটনার সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল— প্রতিটি সৈনিকেরই নিজস্ব জীবন, অতীত, স্নেহময় স্ত্রী, আদরের সন্তান এবং দেখভালের মতো একটা পরিবার আছে। আমরা যখন কোনও সৈনিককে শাস্তি দিই, তখন মনে রাখতে হবে, তার সঙ্গে রক্তের বন্ধন ও আবেগীয় সম্পর্ক থাকা ওই মানুষগুলোও অঙ্গীভূতভাবে সেই শাস্তির বোঝা বয়ে বেড়ায়। আজ যখন দেখি কিছু তরুণ কমান্ডিং অফিসার সামান্য ভুলের জন্য কোনও সৈনিককে শাস্তি দেন, অথচ সেই শাস্তি তার পরিবারে কী প্রভাব ফেলতে পারে সেদিকে গুরুত্ব দেন না, তখন আমার গভীর আক্ষেপ হয় যে বছরের পর বছর ধরে সেনাবাহিনীতে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতিতে কিছুটাও হলেও পরিবর্তন আনতে পারলাম না।

এবার ১৯৯০ সালের কথায় আসি। মাঝরাতে বাঘাইহাটের ২আইসি (সেকেন্ড ইন কমান্ড) মেজর শাকিল (যিনি পরে মেজর জেনারেল হন) আমাকে দিঘীনালায় ফোন করে জানান— শান্তিবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে হানা দিতে গিয়ে লেফটেন্যান্ট মুশফিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁকে দ্রুত এভাকুয়েট করতে হবে। তিনি ২৪ পদাতিক ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না, লাইন বেশ দুর্বল ছিল। তাই আমার সাহায্য প্রয়োজন। আমি সঙ্গে সঙ্গে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সংগে যোগাযোগ করে দ্রুত হেলিকপ্টার পাঠানোর অনুরোধ জানাই। ডিভিশন থেকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, “ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই পাঠানো হবে।” কিন্তু রাত পার হয়ে ভোরের আলো ফোটার পরও হেলিকপ্টার এলো না। লেফটেন্যান্ট মুশফিক অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পরে এ বিষয়ে এক আন্তবাহিনী তদন্ত অনুষ্ঠিত হয় এবং দায়ী ব্যাক্তিদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়। এরপর থেকে মেডিক্যাল এভাকুয়েশনের জন্য আর কখনোই হেলিকপ্টার আসতে দেরি করেনি।

কিন্তু এই বিচারে কি লেফটেন্যান্ট মুশফিকের বাবা-মায়ের মন শান্ত হয়েছিল? একমাত্র সন্তান হারিয়ে তাঁরা তো পুরোটাই ভেঙে পড়েছিলেন। এমন এক গুরুদায়িত্বে থাকা মানুষদের দায়িত্বজ্ঞান ফিরিয়ে আনতে একজনের সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রয়োজন ছিল কি? অনেক বছর পর, আমি যখন ১১ পদাতিক ডিভিশনের কর্নেল স্টাফ, লেফটেন্যান্ট মুশফিকের বাবা আর্থিক সহায়তার আশায় এসেছিলেন। তখন জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী জি এস ও-১ পদে ছিলেন। তিনি জিওসি-র কাছে কমান্ড ফান্ড থেকে কিছু টাকা দিতে সুপারিশ করলে, জিওসি তাকে ২০০০ টাকা দিতে বলেন। সেই অসহায় বৃদ্ধ সামান্য টাকাটুকু হাতে নিয়ে ফিরে গেলেন। হয়তো মনে মনে ভাবলেন—“আমি এমন এক বীরের বাবা, যে দেশের জন‍্য প্রাণ দিয়েছে অথচ সে দেশ তার পরিবারকে সামান্য সহমর্মিতা দেখাতেও অনিচ্ছুক !”

আজ আমরা দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিহত অফিসারের স্ত্রী/সন্তানদের জন্য ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করি, সন্তানদের বিনামূল্যে পড়াশোনার সুযোগ ও বিধবা স্ত্রীকে চাকরির নিশ্চয়তা দিই। কিন্তু তখন এসব সিদ্ধান্ত ছিল না। ফলে লেফটেন্যান্ট মুশফিকের বাবার ভাগ্যে সেসব জোটেনি। তিনি এখন কোথায়, আদৌ বেঁচে আছেন না চলে গেছেন জানি না। তবে এটা স্পষ্ট যে, এক সাহসী সৈনিক যিনি দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে “বীর উত্তম” উপাধি পেয়েছিলেন, তাঁর বাবার প্রতি আমরা সুবিচার করিনি।

এই দুটি ঘটনায় বিচলিত বা হতাশ হওয়ার কারণ নেই। বর্তমানে সেনাবাহিনী অনেক পরিণত। নিহতদের পরিবারের কল্যাণের জন্য সেনানবাহিনীর সুস্পষ্ট কর্মসূচি রয়েছে। আমরা কেবল নিজেদের সৈনিকদের কথাই ভাবি না, বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বীরত্বপূর্ণ কাজ করা বেসামরিক নাগরিকদের পরিবারের প্রতিও হাত বাড়াই। উদাহরণস্বরূপ, রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে শাহীনাকে উদ্ধারের সময় জীবন উৎসর্গকারী স্বেচ্ছাসেবী কায়কোবাদ-এর পরিবারকেও আমরা সহায়তা দিয়েছি।

আমার শ্বশুরবাড়ির পক্ষের এক নিকটাত্মীয় ছিলেন, যিনি এএমসি-তে কর্নেল পদে (কর্নেল ফজলু) অবসর নিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি দুবার ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি হন। প্রতিবারই তিনি আমাকে ডেকে বলেন, “ডাক্তাররা আমাকে দেখতে আসছেন না।“ দু দিন পেরিয়ে যাবার পর প্রথম ডাক্তার তাঁর কেবিনে যান। এতে আমি খুব মর্মাহত হই— যে কর্নেল এই সিএমএইচে নিজের সেরা সময়টা ব্যয় করে প্রতিদিন এত রোগী দেখেছেন, তাঁকেই অবসরে এসে তাঁরই গড়ে তোলা ডাক্তারদের অবহেলার শিকার হতে হচ্ছে!

অনেক রোগী নিছক চিকিৎসকদের উদাসীনতার কারণে মারা গেছেন— বা বলা যায় “মেরে ফেলা হয়েছে।” বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, কিছু ডাক্তার মনে করতেন, রোগীর কেস-হিস্টরিতে তথ্য লিপিবদ্ধ করাই যেন একমাত্র চিকিৎসা। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর, আমি সিএমএইচগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো ও উন্নত করার সংকল্প করি। এ নিয়ে সারাদিন ধরে ডাক্তারদের সঙ্গে অসংখ্য সভা করি, অনেক সিদ্ধান্ত নেই, যদিও কম বাধার মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু আজ আমি গর্ব করে বলতে পারি, সিএমএইচগুলোতে যে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা ছিল, তা দূর করে আর্মি মেডিক্যাল কোরের নেতৃত্বে এবং ডাক্তার-নার্সদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা এক স্বপ্নের হাসপাতাল গড়ে তুলতে পেরেছি। এখন তারা আরও সক্রিয় হয়ে অফিসার, সৈনিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের সর্বোত্তম চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। জরুরি বিভাগ ও ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড এখন শুধু সামরিক বাহিনীতেই নয়, গোটা দেশের মধ্যেই একটি উন্নত সেবার মডেল হয়ে উঠেছে।

প্রায়ই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সৈন্যরা ফোন করে জানান, সিএমএইচে তাঁরা কী অসাধারণ যত্ন পেয়েছেন— ডাক্তার, নার্স ও মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টরা কতটা আন্তরিকভাবে সেবা দিয়েছেন। সাবেক সেনাপ্রধানরা সিএমএইচ পরিদর্শনে এসে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন এবং বলেছেন, তাঁদের সময়ে এসব সমস্যা ঠিক করতে তাদেরকে কতটুকু বাধাগ্রস্থ হতে হয়েছে। বর্তমানে যেসব পরিবর্তন হয়েছে, তা দেখে তাঁরা উচ্ছ্বসিত।

বিদেশে আয়োজিত বিভিন্ন কোর্সে অংশ নিয়ে আমাদের ডাক্তাররা আরও দক্ষ হয়ে উঠেছেন। রোগীদের প্রতি তাঁদের মনোভাবেও নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। সম্প্রতি আমি বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শনের সময় দেখেছি, চিকিৎসকেরা পদ পদবীর বিচার না করে রোগীদের গা স্পর্শ করে পরীক্ষা করছেন— যা আগে অনেক কম দেখা যেত। এখনকার প্রজন্মের ডাক্তাররা অনেক বেশি পেশাদার, দক্ষ, নীতিগতভাবে দৃঢ় এবং রোগীদের প্রতি যথার্থ ব্যবহার করছেন। ঢাকার সিএমএইচের কমান্ড্যান্ট ও তাঁর পুরো দলকে আমি ধন্যবাদ জানাই— তাঁদের অক্লান্ত চেষ্টায় সিএমএইচকে সত্যিকারের “স্বপ্নের হাসপাতাল” হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এ ধারা অবশ্যই চলমান রাখতে হবে।

আমরা একজন ব্যাক্তির গৌরব ও মর্যাদাবোধকে কতটা সম্মান করি? ১৯৭৫ সালে সৈনিকদের ক্রোধ যখন কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হয়েছিল, তখন ‘সোলজার-ব্যাটম্যান’ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সেই মানসিকতা এখনও বিদ্যমান। ১৯৭৫-এর অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও, কিছু অফিসার শুধু সৈনিকদেরই নয়, চতুর্থ শ্রেণির বেসামরিক কর্মচারীদের সঙ্গেও রূঢ় আচরণ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার বলা তিনটি ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টি বোঝাতে চাই—

ঘটনা ১: আমি ও আমার ক্যাম্প কমান্ডার চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে টহল শেষে ফিরলাম। গোলঘরে অস্থায়ী বেঞ্চে আমরা দু জন এসে বসলাম। ক্যাম্প কমান্ডারের রানার এসে হাঁটু গেড়ে তাঁর জঙ্গলবুট খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। ডান পায়ের বুটের ফিতাতে একটা জট পাকানোর কারণে খুলতে দেরি হচ্ছিল। এতে ক্যাম্প কমান্ডার রেগে উঠে অন্য পা দিয়ে রানারের গালে লাথি মারেন। আমি এতটাই হতভম্ব হয়ে যাই যে,তাঁর সঙ্গে আগে আমার যে স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল, সেটি মুহূর্তেই উবে যায়। ইউনিটের বাকি মেয়াদকালে উনার সাথে আমি আর কখনও  স্বাভাবিক আচরণ করতে পারিনি।

ঘটনা ২: এক অফিসার মেসে খাওয়ার সময় খাবারে তেলাপোকা পেয়ে বাবুর্চিকে ডেকে আনলেন। বারবার ক্ষমা চাওয়া সত্ত্বেও, তাঁকে সেই তেলাপোকাটি গিলতে বাধ্য করলেন। পরদিন বাবুর্চি অনুপস্থিত (AWOL) হয়ে যায়। ৩৭ দিন পর ইউনিটে ফিরে আসলে সামারি কোর্ট মার্শালে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

ঘটনা ৩: এটি আরও ভয়ংকর। একজন মেস ওয়েটার অফিসার্স মেসে বেঁচে যাওয়া খাবার খেতে গিয়ে মেস সেক্রেটারির নজরে আসেন। মেস সেক্রেটারি ওয়েটারের মাথায় গরম পানি ভর্তি একটি বড় পাত্র চাপিয়ে দিতে বলেন এবং নির্দেশ দেন যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি অনুমতি দেবেন, ততক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে (সেনাবাহিনীতে এটি হান্ডি প্যারেড নামে পরিচিত)। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দেখা গেল, পাত্রের ওজন ও গরমের তাপে ওয়েটারের পা কাঁপছে। আমি বিনীতভাবেীত মেস সেক্রেটারিকে অনুরোধ করি, “দয়া করে তাকে ক্ষমা করে পাত্র নামানোর সুযোগ দিন”। কিন্তু তিনি ধমক দিয়ে বলেন, “ সেনাবাহিনীকে সোজা রাখতে গেলে এসবের প্রয়োজন আছে।  শিখে নাও।” এক পর্যায়ে, ওয়েটার আর দাঁড়াতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। পাত্রটির গরম পানি তার ডান পায়ের উপর পড়লে সেটি মারাত্মকভাবে পুড়ে যায়। বেচারাকে কয়েক মাস হাসপাতালে থাকতে হয়।

ঘটনাগুলো শুনে আপনারদের কী ধারণা হচ্ছে? শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বিষয়টুকু বাদই দিলাম। আমরা কি আমাদের অধীনস্থ বা নিম্নপদস্থ মানুষদের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও গৌরববোধকে আদৌ সম্মান করি-যারা আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দের জন্য নিঃস্বার্থভাবে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমরা বেশিরভাগই তুলনামূলকভাবে সচ্ছল পরিবার থেকে এসেছি। নৈতিকতা ও আদর্শিক শিক্ষাও পেয়েছি। তবুও কীভাবে আমরা আমাদের অধীনস্থদের উপর এমন নির্মম হতে পারছি? আজও আমার পক্ষে বুঝে উঠা সম্ভব হয়ে উঠেনি যে, একজন মেস ওয়েটারের মাথায় গরম পানি ভর্তি পাত্র চাপিয়ে কীভাবে সেনাবাহিনীকে সোজা রাখা হয়!

অনেক বছর পর, যখন আমার হাতে দায়িত্ব এলো, আমি মানুষকে বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছি— “প্রত্যেক ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে।” দরবারে সৈনিকদেরকে চেয়ারে বসানো, ঘাস কাটার জন্য কাঁচির বদলে মেশিন তুলে দেওয়া, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা, ইউনিফর্ম ইস্ত্রি বা বুট পালিশের মতো ছোটখাট কাজে সৈনিকদের না লাগানো, এমনকি সন্তানদের স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজ থেকেও তাদের বিরত রাখা— এসবই মূলত “মানুষের মর্যাদা” রক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপ। সামাজিক অবস্থান বা মর্যাদা যাই হোক, সবার মৌলিক সম্মান বজায় রাখা জরুরি।

অনেক কর্মকর্তাই আমার এই উদ্যোগকে ভুলভাবে বোঝেন; তাঁরা হয়তো উপলব্ধি করতে পারেননি কেন আমি এ ধরনের পরিবর্তন আনতে চেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, আমি চলে যাওয়ার পর তাঁরা পিছন ফিরে তাকিয়ে আমার এই পদক্ষেপগুলো নেওয়ার কারণ ও দর্শন উপলব্দি করবেন এবং এগুলোর প্রতি তাঁদের মানসিক প্রতিরোধের অসারতা বুঝতে পারবেন।

আমার কর্মজীবনে আমি “অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম”এবং চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে সরাসরি অভিযানে অংশগ্রহণ করেছি। ২২ ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহের সময় গুলির ঝড়ের মধ্য দিয়ে অফিসার্স মেস থেকে বেরিয়ে বেঁচে এসেছি। পাহাড়ে পাঁচবার অ্যামবুশে পড়েছি— অন্তত একবার ছিলাম মৃত্যুর একেবারে কাছাকাছি। কিন্তু নেতৃত্বের আসনে থেকে কোনো অভিযানে আমার অধীনে থাকা কেউ যখন নিহত হয়, তখন কেমন অনুভূতি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বাবুছড়ায় আমি এবং জেনারেল মাকসুদ (বর্তমানে বিপসটের কমান্ড্যান্ট) পরিচালিত অভিযানে এক আনসার মারা যান। তখন  রাগ, হতাশা, অসহায়ত্ব আর দুঃখের সংমিশ্রণে যে অনুভূতি তৈরী হয়েছিল তা দ্রুতই আমাদের দু জনের অন্তরকে অসাড় করে তোলে।

ওই আনসারের ভাই একই ক্যাম্পে ছিলেন; লাশ আসার সময় তার আহাজারি এখনও আমার কানে বাজে। সেই দিন, আমরা দুপুরের খাবার না খেয়ে রুমে গিয়ে ঘুমাই রাত নয়টা পর্যন্ত। পরদিন আরেকটি অভিযানের ডাক ছিল, তাই ঘটনাটির তাৎক্ষণিক প্রভাব কিছুটা থিতিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেটি কখনো পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। আমি “কিলার অ্যাঞ্জেলস” নামে একটি বই পড়েছিলাম, যেখানে আমেরিকান সিভিল ওয়ারের গেটিসবার্গ যুদ্ধের বর্ণনা আছে। জেনারেল লি ও গ্রান্ট যেভাবে একের পর এক নিষ্ফল আক্রমণে সৈন্যদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছিলেন, সেটা পড়ে আমি শিউরে উঠেছিলাম। ভাবছিলাম, আমি কি একই রকম পরিস্থিতিতে আমার সৈনিকদের এমনভাবে উৎসর্গ করতে পারবো? বাবুছড়ার অভিজ্ঞতা বলছে— “না।” তবে এটিও ঠিক একজন তরুণ মেজরের মানসিকতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই বদলায়। গত তিন বছরে আমাকে অনবরত মুহূর্তে মুহূর্তে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যা অগণিত মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে— ভালো এবং মন্দ দু ভাবেই।

আমি এসএসসি-৩ কোর্সের সদস্য। আমরা পাস করেছিলাম ৯৮ জন, এখন সেই সংখ্যা কমে ৮৩-তে দাঁড়িয়েছে। কেউ সামরিক বিদ্রোহের দায়ে ফাঁসি বা কারাদণ্ড ভোগ করেছে, কেউ চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকায় বা পিলখানায় নিহত হয়েছে, আবার কেউ সড়ক বা লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা গেছে; অনেকে বয়সজনিত কারণে বা রোগে মারা গেছেন। এখনো যারা চাকরিতে আছেন, তাদের মধ্যে অনেকে নানা অসুখে ভুগছেন, আবার কেউ কেউ অবসর নিয়ে দ্বিতীয় কর্মজীবনে ভালো করছেন। আমার কোর্সমেটরা আমাকে সবসময় নানাভাবে সহায়তা করেছেন এবং উৎসাহ যুগিয়েছেন। সামরিক বাহিনীতে ভালো করার অনুপ্রেরণার মূল উৎস ছিল তারাই।

গত ৩৯ বছরে আমি অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে এসেছি।অফিসার, জেসিও, অন্যান্য পদবীর সৈনিক, বেসামরিক কর্মচারী, ঊর্ধ্বতন, অধস্তন, পুরুষ, নারীসহ সবার সঙ্গেই মিশেছি। তাদের সাহচার্য্য আমার জীবনের ছবিটিকে সবসময় রংধনুর মত রাঙিয়ে দিয়েছে। আমরা একসঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করেছি, সাফল্য উদ্যাপন করেছি, আবার নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। যেসব কমান্ডিং অফিসার, ব্রিগেড কমান্ডার ও জিওসির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, তাঁরা সব সময় প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা দিয়ে আমাকে পরিচালনা করেছেন এবং আমাকে উচ্চমানের পেশাদার হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে, আমি যখন বিভিন্ন দায়িত্বে বা পদে গেছি, প্রায়ই তাঁদের নেতৃত্বশৈলীকে স্মরণ করে সেভাবেই কাজ করার চেষ্টা করেছি।

আমি আমার অধস্তনদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। হাবিলদার রুহুল আমিন আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে রিকয়েললেস রাইফেল চালাতে হয়। পিওএল এনসিও, নায়েক শহিদ আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে ভিডিআরএ (VDRA) রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। নায়েব সুবেদার মাহবুব আমাকে শিখিয়েছেন ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হিসাবে কীভাবে বি ইশেলন (B echelon) গঠন করতে হয় এবং মাঠে মোতায়েন সৈন্যদের খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হয়। আর সুবেদার শহিদ আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে সৈন্যদের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া যায়। তাঁদের অনেকে আজ বেঁচে নেই। অনেকের মুখমণ্ডল সময়ের আবহে ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু আমি আজ যে অবস্থায় পৌঁছেছি— তার পেছনে তাঁদের অবদান অসামান্য।

সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি বাহিনীকে সুরক্ষিত রাখতে এবং একে কার্যকর যুদ্ধশক্তিতে পরিণত করতে। বাহিনীর শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান বদলানোর চেষ্টা করেছি। পর্যাপ্ত অবকাঠামো যেমন জিম, সুইমিং পুল, কিল হাউস ইত্যাদি নির্মান করা হয়েছে। নতুন শারীরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে বাহিনীর যুদ্ধ-সক্ষমতা আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আমি অনুরোধ করব, আমার অনুপস্থিতিতে এসব অবকাঠামো যেন অযত্নে নষ্ট না হয়।

শিক্ষাবিষয়ক কর্মসূচি অফিসার ও সৈন্যদের বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা বাড়াতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবে। আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহারে তারা আরও পারদর্শী হবে এবং একুশ শতকের নতুন যুদ্ধক্ষেত্রের বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে পারবে। ইতিমধ্যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বেশ দৃশ্যমান— সৈন্যরা ধীরে ধীরে গ্রামীণ পরিসর থেকে শহুরে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে। নতুন প্রজন্মের অফিসার ও সৈন্যরা বুদ্ধিদীপ্ত, স্মার্ট, সৃজনশীল এবং মানসিকতায় আধুনিক। সিনিয়র-জুনিয়র অফিসারদের মধ্যকার ব্যবধান এবং অফিসার-সৈন্যদের মাঝে যে ফারাক আগে ছিল, তা এখন অনেকটাই সেতুবন্ধন দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। বাহিনী এখন আগের চাইতে আরও ঐক্যবদ্ধ, সুসংহত ও নিরবচ্ছিন্ন। এই ধারা অব্যাহত রাখুন এবং আরও ভালো কিছু করে দেখান।

শেষে আসি আমার স্ত্রীর কথায। আমার স্ত্রী বেগম তাহমিনা করিম। আমি সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বপালনকালে যে নৈতিক ও মানসিক সহায়তা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি, তা না থাকলে আমার কাজের গতি ও কার্যকারিতা হয়তো অর্ধেকে নেমে আসতো। আমি সারাক্ষণ কাজে নিমগ্ন ছিলাম বলে পুরো পরিবারের দায়িত্ব তাঁর হাতে তুলে দিয়েছি। আমার অমনোযোগ সত্ত্বেও তিনি পরিবারের সব দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন এবং সন্তানদের সঠিক পথে রাখতে পেরেছেন। কখনো কোনো বিষয়ে অভিযোগ না তুলে আমাকে বুঝে গেছেন ও সহ্য করেছেন। ধন্যবাদ, মিসেস করিম— আমার সমস্ত অতি-কর্মপ্রিয়তা মেনে নেওয়ার জন্য এবং আমাকে অবিরাম অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য।

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়,

পেছন ফিরে তাকালে আমাদের সবার সম্মিলিত সাফল্য গর্ব জাগায়। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি এবং স্বীকৃত এক মানদণ্ড অর্জন করেছি। যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের সবাইকে স্যালুট- আপনারা এই বাহিনীর ঐক্য অক্ষুণ্ণ রেখেছেন এবং আমাদেরকে ধৈর্যশীল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে শিখিয়েছেন, যাতে আমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আরও ঐক্য, স্থিতিশীলতা ও পেশাদারিত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়,

আমার উত্তরসূরি, জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক একজন স্বনামধন্য সামরিক নেতা। আমি বিশ্বাস করি, তাঁর প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও সহজাত উদ্যমের মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীকে আরও উন্নতির চূড়ায় নিয়ে যাবেন। জেনারেল, আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা, দোয়া, সহযোগিতা ও পরামর্শ সর্বদা আপনার সঙ্গে থাকবে।

জেনারেল, আমার স্ত্রী আর আমি এই চমৎকার নৈশভোজের আয়োজনের জন্য আপনাদের দু জনের— আপনি এবং বেগম শোমা হক— নিকট গভীর কৃতজ্ঞ। বিদায়স্মৃতি হিসেবে যে স্মারক ও উপহার আমাদেরকে দিয়েছেন, সেগুলো চিরদিন আমাদের মনে করিয়ে দেবে এই প্রিয় বাহিনীর সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ পথচলার কথা।

আমি যখন ক্যান্টনমেন্টের ফটক পেরিয়ে যাবো, তখন চোখের উপর টুপিটি নামিয়ে নেবো এবং একটু কাঁদবো, যাতে আপনারা কেউ দেখতে না পান।

আল্লাহ আমাদের সবার মঙ্গল করুন।

ধন্যবাদ, জেনারেল বেলাল।

ধন্যবাদ, সম্মানিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ।

আল্লাহ হাফেজ…

লেখক: জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া

সাবেক সেনাপ্রধান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

9,600FansLike

Latest Articles